প্রণোদনার ২৫০০ টাকা কাজে লাগিয়ে স্বাবলম্বী রাজশাহীর আনোয়ারা

প্রণোদনার ২৫০০ টাকা কাজে লাগিয়ে স্বাবলম্বী রাজশাহীর আনোয়ারা

প্রণোদনার ২৫০০ টাকা কাজে লাগিয়ে স্বাবলম্বী রাজশাহীর আনোয়ারা
প্রণোদনার ২৫০০ টাকা কাজে লাগিয়ে স্বাবলম্বী রাজশাহীর আনোয়ারা

এসএম বিশাল: রাজশাহী নগরীর শিরোইল কলোনির বাসিন্দা মো. আব্দুল খালেক (৪৫)। অন্যের অটোরিক্সা চালিয়ে চলত তার পরিবার। কিন্তু করোনায় কর্মহীন হয়ে পড়ায় মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে তার। অত:পর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের দ্বারা রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন (রাসিক) থেকে প্রধানমন্ত্রীর উপহার পেয়েছিলেন ২৫০০ টাকার প্রণোদনা। সেই অর্থ খরচ করতে দেননি স্ত্রী মোসা. আনোয়ারা বেগম (৪০)। প্রণোদনার সামান্য সেই অর্থ কাজে লাগিয়ে কেনেন চা বানানোর বড় পাতিল, একটি ফ্ল্যাক্স ও ব্যবসার অন্যান্য উপকরণ। এরপর অনেকটায় নিশ্চিতে দিন কাটে খালেক ও আনোয়ারার।

ভদ্রার মোড় রেশম ভবনের সামনে আনোয়ারর খুদ্র ব্যবসা

আব্দুল খালেকের স্ত্রী আনোয়ারা বেগমের। আনোয়ারা বেগম দুই সন্তানের জননী। রাজশাহীতেই তার আদি নিবাস। যদিও আনোয়ারা ও তার স্বামীর পৈত্রিক ভিটেমাটি নেই। তাই থাকতে হয় ভাড়া বাসায়। তারপরও ছেলেমেয়েকে শিক্ষিত করেছেন তিনি। আনোয়ারর স্বপ্ন ছেলেমেয়ে লেখাপড়া শিখবে, বড় হয়ে করবে ভালো কোনো চাকরি। তার বড় মেয়ে মোসা. খালেদা আক্তারকে (১৯) পাশ করিয়েছেন এসএসসি। সেও মায়ের মতোই স্বাবলম্বী হয়েছে। চাকরি করছেন হাই-ফাই প্লে জোন নামক একটি প্রতিষ্ঠানে। ছোট ছেলে সজীব (১২) নগরীর ইউসেফ স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। ক্লাশ খোলায় এখন সেও যাচ্ছে স্কুলে।

প্রথমার্ধের গল্পে বর্ণনায় বুদ্ধিমতি আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে গাড়ি-ঘোড়া সব বন্ধ হয়ে পড়ে। এতে কর্মহীন হয় স্বামী। আমিও দুটি বাড়িতে কাজ করতাম। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে আমাকেও তারা কাজে আসতে বারণ করে দেয়। এতে দু’জনেই কর্মহীন হয়ে পড়ি। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে কয়েকদিন খুব কষ্ট করতে হয়।

তিনি বলেন, অত:পর ২০১৯ সালের এপ্রিলের দিকে আমাদের কাউন্সিলর সুমনের কাছে ত্রাণ সাহায্যের জন্য যায়। তিনি রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন থেকে আমাদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে প্রদানকৃত ২৫০০ টাকার অনুদানের ব্যবস্থা করে দেন। আমার স্বামী টাকাটি নিয়ে বাড়ি এলে আমি তাকে টাকাটি খরচ করতে দেয়নি। তাকে সাথে করে বাজারে গিয়ে একটি চায়ের ফ্ল্যাক্স ও চা বিক্রির অন্যান্য জিনিসপত্র কিনে আনি। তারপর থেকে আমি চা বানিয়ে দেয়, আর সে বাইরে গিয়ে হেটে হেটে বিক্রি করত। তবে একটা চায়ের ফ্ল্যাক্স দিয়ে চা বিক্রি খুব বেশী টাকা আয় হতো না। কিছুদিন পর আবার আরেকটা কিনে দেয়। দুমাস পর আরও দুটি, এভাবে মোট ৪টি চায়ের ফ্ল্যাক্স কিনি। দুটি সে বাইরে বিক্রি করত, আর দুটি চায়ের ফ্ল্যাক্স নিয়ে আমি ভদ্রার মোড় রেশম বোর্ডের পাশে বসে বিক্রি করতাম। এভাবে আমাদের আবার সুদিন ফিরে আসে।’

আনোয়ারা জানান, রেল মার্কেটের মানুষের অনুরোধ ও রেশম ভবনের কিছু ধরাবাধা কাস্টমার হওয়ায় রেশম বোর্ডের রাস্তার পাশেই চা, পান-সিগারেট নিয়ে ব্যবসা শুরু করি। প্রথমে একটা টেবিল থাকলেও এখন দুটো টেবিল নিয়ে খোলা আকাশের নিচেই চলছে ব্যবসা। তবে দীর্ঘ সময়ধরে আমার স্বামী শ্বাসকষ্টে ভুগছেন, আর তাই বেশিরভাগ সময়ে আমিই দোকানে সময় দেয়। সেও মাঝে মধ্যে এসে দোকানে সময় দেয়।’

রেশম বোর্ডের কর্মচারী আসাদ। অফিসের ফাকে চা খেতে এসেছেন আনোয়ারার চায়ের দোকানে। তিনি জানান, ‘অফিসের পাশে এই চায়ের দোকানটা হয়ে খুব ভালো হয়েছে। চা-বিস্কিটের জন্য এখন আগের মতো আর দূরে যাওয়া লাগে না।

রেশম বোর্ডের বিপরীতে রয়েছে অসংখ্যা রেলওয়ের মার্কেট। সেখান থেকেও আসে আনোয়ারার চায়ের দোকানের ক্রেতা। রেল মার্কেটের লোহা ও রড ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আনোয়ারা আপার দোকানটি প্রায় দুবছর হয়েছে চালু হওয়া। রেল মার্কেট ও রেশম বোর্ডের আশ-পাশে তেমন চায়ের দোকান নেই। চা কিংবা পান-সিগারেট খেতে হলে যেতে হয় একেবারে ভদ্রামোড়ে। আপার দোকানটি হওয়ায় আমাদেরও সুবিধে হয়েছে। তাছাড়া আপার হাতের চা ও পান দুটোই অত্যন্ত মজার।’

জীবন সংগ্রামী আনোয়ারার প্রতিবেদককে বলেন, ‘অনেক কষ্ট শেষে এখন ভালোই আছি ভাই। ছেলে-মেয়ে স্বামী নিয়ে বেশ ভালোই চলে যাচ্ছে। বুদ্ধি করে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ২৫০০ টাকা কাজে লাগিয়েছিলাম বলে আজ আমরা স্বাবলম্বী। তানাহলে আজও আমাকে মানুষের বাড়িতে ঝিগিরি করতে হতো, আর আমার স্বামীকে অন্যের অটো চালাতে হতো। সবমিলিয়ে আল্লাহ এখন ভালোই রেখেছে ভাই।’

প্রতিদিন কেমন ব্যবসা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন তাও ৩ থেকে ৪ হাজার টাকার বেচা-বিক্রি হয়। এতে লাভ থাকে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। তাতে ছেলেমেয়ে নিয়ে ডাল-ভাত খেয়ে ভালোই চলে যাচ্ছে।’

আনোয়ারার বিষয়ে কথা হয় রাসিকের ১৯নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তৌহিদ হক সুমনের সাথে। প্রণোদনার সামান্য অর্থ দিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে উঠার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘করোনার শুরুতে তারা একবার এসেছিল আমার কাছে আর্থিক সহযোগিতার জন্য। তৎপ্রেক্ষিতে আমি তাদের রাসিকের প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনার লিষ্টে তাদের নাম অন্তর্ভূক্ত করায়।’

তিনি বলেন, ‘ভেবেছিলাম সেটা দিয়ে অন্তত তারা ক’টা দিন খেয়ে পরে বাচতে পারবে। কিন্তু আনোয়ারা ওই সামান্য অর্থ নষ্ট না করে নিজের বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে এভাবে স্বাবলম্বী হতে পেরেছে, এটা ভেবেই আমার ভালো লাগছে। তাদের দেখে সমাজের অন্যান্যদের শিক্ষা নেওয়া উচিৎ বলেও মন্তব্য করেন এই ১৯নং ওয়ার্ডের এই জনপ্রতিনিধি।

তিনি আরও বলেন, আমাদের সমাজে এখন নারী মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তারা বিপদগামী হচ্ছে। এতে করে যুবসমাজ ধংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সে সকল নারী আনোয়ার মত সল্প পুজি নিয়ে খুদ্র ব্যবসায় উদ্দ্যোগী হলে সমাজ এবং দেশ রক্ষা পাবে।

মতিহার বার্তা / ইএবি

খবরটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply